টিপু দৌড়চ্ছে।
টিপুর সামনে তিন জন অ্যাথলেট, পেছনে দু’জন।
আফসানা বেগম চোখ মুখ শক্ত করে গ্যালারীতে বসে আছেন। আফসানা বেগমের বাম হাত পাশের চেয়ারে হামিদুর রহমানের হাতে ধরা। স্ত্রীর উত্তেজনা হামিদুর রহমানের ভেতরেও সংক্রমিত। টিপু কি পারবে এবার?
আফসানা বেগমের এক সারি পেছনে দিপু। পেছনে বসার কারনে মা আফসানা বেগমের সাথে দিপুর চোখাচোখি হচ্ছে না।
ফিনিশিং লাইন থেকে প্রতিযোগীদের দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। তিন শ’ ফিট বাকি থাকতে টিপুর পায়ের গতি সহসাই দ্বিগুণ হয়ে গ্যালো। টিপু এখন যন্ত্র শকটের মত ছুটছে। একজন একজন করে টিপু সামনের তিন জনকেই পাশ কাটিয়ে গ্যালো। তারপর চিতার মত ক্ষিপ্র গতিতে ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করল। শেষ মুহূর্তের খন্ডকালীন স্তব্ধতা ভেঙ্গে গ্যালারীতে তখন তুমুল করতালি।
আফসানা বেগম উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গ্যাছেন। সামনে তাকিয়ে তিনি টিপুকে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালেন। তারপর ঘুরে তাকালেন দিপুর দিকে। আফসানা বেগমের এই তাকানোটাই দিপু এতক্ষণ এড়াতে চাইছিল। কিছুটা অবজ্ঞার আর কিছুটা বিরক্তি ভরা এই অভিব্যাক্তির অর্থ হলোঃ টিপুও আমার ছেলে, তুমিও। অথচ ও কি আর তুমি কি।
এর প্রায় মাস খানেক পর।
নবম শ্রেণীর পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। কোন বিষয়েই দিপুর গ্রেড বি এর উপর ওঠেনি। রিপোর্ট কার্ড হাতে দীপুর বাবা হামিদুর রহমান আর মা আফসানা বেগম অনেক ক্ষণ থম মেরে বসে থাকলেন। তারপর হামিদুর রহমান দিপুকে ডেকে বল্লেন,
‘দিপু, ভুলটা তোমার না,ভুলটা আমার।’
‘কী ভুল?’ দিপু জানতে চাইলো।
‘আমার ধারণা ছিল টিপুর মত তুমিও এ প্লাস পেয়ে যাবে…’
‘সেটাই ভুল?’
‘না ভুলটা হলো, সময় মত চাবকে তোর পিঠের ছাল তুলে ফেলা উচিত ছিল। এরকম কুৎসিত রেজাল্ট তাহলে দেখতে হতো না’
এবার আফসানা বেগম মুখ খুললেন,
‘তোমার জন্মের আগে একবার অ্যাবরশনের কথা ভেবেছিলাম। না করাটাই ছিল আমার জীবনের সবচে’বড় ভুল। এমন এম্বেসাইল ছেলেকে সবার সামনে প্রেজেন্ট করতেও লজ্জা হয়’
দিপু মা’র কথার প্রতিবাদ করার আগেই ওর সারা গায়ে নির্বিচারে জুতোর বাড়ি পড়তে লাগলো। হামিদুর রাহমান ক্রোধে এমনই উন্মত্ত যে একবার গিঁট খুলে ওনার লুঙ্গী মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। লুঙ্গি ঠিক করে এবার দিপুকে তিনি হাঁটু দিয়ে বিছানায় পিষে ধরলেন। এলোপাথাড়ি চপেটাঘাতে টিপুর মনে হলো সে এখুনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।
এক সময় হামিদুর রহমান ক্লান্ত হলেন। দিপুকে তখন মেইন গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। ওর গলায় নাইলনের রশি দিয়ে ঝোলানো একটা প্ল্যাকার্ড। সেখানে লাল কালি দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখাঃ ‘আমি আনিসুর রহমান দিপু। আমি পরীক্ষায় বি এবং সি গ্রেড পেয়েছি। আমার ভবিষ্যৎ লোড শেডিং-এর মতই অন্ধকার’।
সামনের বাড়ির রুমানা তখন রিক্সা করে যাচ্ছে। রুমানার প্রতি দিপুর ভেতরে একটা গহীন গোপন দুর্বলতা আছে। রুমানা যখন বারান্দার রোদে চুল শুকোয় দিপুর মন তখন আর্দ্র আবেগে ভিজে ওঠে। রুমানা যখন বর্ষার নবধারাজলে স্নান করে, দিপুর হৃদয় তখন তৃষার্ত মরুভূমির মত শুকিয়ে যায়।
দিপুকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় রুমানার ঠোঁটে বাঁকা হাসি লেগে ছিল। তাচ্ছিল্য আর বিদ্রূপ ভরা সেই হাসি যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো বামন আরে চাঁদের দূরত্ব। দীপুর তখন গলা উগড়ে কান্না বেরিয়ে আসছে। কিন্তু কান্নার দমক ছাপিয়ে জেগে উঠেছিল অপমান আর হীনতাবোধ।
দিনগুলো, রাতগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিপুর। কোন কিছুতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না। না লেখাপড়ায়, না খেলাধুলায়। দিপু এত দিনে বুঝে গ্যাছে সে কখনোই টিপুর মত হতে পারবে না। টিপুকে যেন পৃথিবীতে পাঠানোই হয়েছে অন্যের চোখ ধাধিয়ে দেয়া এবং সেই ধাঁধানো আলোয় অন্যের হীনতাকে আরও প্রকট করার জন্য। এক ঘরে পাশাপাশি থাকলেও টিপুর সাথে ওর খুব কমই কথা হয়।
দিপু অনেক ভেবেছে। ভেবে ভেবে একটা সিদ্ধান্তে এসেছে।
হেমন্তের এক ম্লান বিকেলে পারাবত এক্সপ্রেস থেকে ভৈরবে রেল ষ্টেশনে নেমে পড়ে দিপু। হলুদ আর বাদামী ঝরা পাতায় ছেয়ে গ্যাছে ষ্টেশনের এবড়ো থেবড়ো বখে যাওয়া পথ। সেই ঝরা পাতা মচ মচ করে মাড়িয়ে দিপু এসে বসে দবির আলির চায়ের দোকানে। দোকানের একমাত্র কাস্টমার চুক চুক শব্দ করে পিরিচে ঢেলে চা খাচ্ছে। লোকটির মুখ আর হাতে সাদা ছোপ ছোপ শ্বেতীর দাগ। । দিপুকে দেখে লোকটির ঠোঁটের কোনে সম্ভাষণমূলক হাসির রেখা ফুটে উঠল। দিপুর মনে হলো এই শ্বেতীগ্রস্ত বন্ধুত্বপ্রবণ লোকটি একটা ফেরেশতা। দবির মিয়া খুব যত্ন করে টেবিলের উপর শরবতের মত পাতলা চা আর সাত-আটদিনের বাসি হলুদ কেক রেখে গেছে। দিপুর কাছে এই যত্নমাখা খাবার অমৃতের মত লাগলো।
বিল মিটিয়ে দিপু রেল লাইন বরাবর উত্তর দিকে হাঁটা ধরল। ধীরে ধীরে ও এসে দাঁড়ালো ভৈরব ব্রীজের ঠিক মাঝখানে।
এক সময় এই ব্রীজের নাম ছিল অ্যান্ডারসন ব্রীজ। অনেক দুঃখ জড়িয়ে আছে এক কিলোমিটার দীর্ঘ এই ব্রীজকে ঘিরে। সবচে’ দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটে ১৯৫০ সালে। ১২ই ফেব্রুয়ারী সমস্ত দিন ধরে আশুগঞ্জ আর ভৈরব বাজার থেকে আগত ট্রেনগুলোয় কারা যেন ভেতর থেকে সব দরজা লক করে দিত। ব্রীজের ঠিক মাঝখানে এসে প্রতিটা ট্রেন হঠাৎ থেমে যেত। ভেতর থেকে বেছে বেছে আলাদা করা হতো হিন্দু যাত্রীদের । এক এক করে এদের কম্পারটমেন্টের বাইরে আনা হতো। তারপর গলা কেটে ছুঁড়ে ফেলা হতো মেঘনা নদীতে। এরকম অনেক মৃত্যুর স্মৃতি মেঘনার জলে মিশে ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গ্যাছে।
আজ যদি আরও একজন এই ব্রীজ না পেরোয়, মেঘনার অতল গর্ভে যদি আরও একজন আজ তলিয়ে যায়, তাতে কারো কিছু যাবে আসবে না।
দিপু এখন ব্রীজের প্রান্তে। নীচে প্রবল বেগে বয়ে যাচ্ছে স্রোতস্বিনী মেঘনা। দিপু এক পা ব্রীজের বাইরে বাড়িয়েছে। ধীরে ধীরে ওর হাতের আঙ্গুলগুলো মরচে ধরা লালচে রঙের পুরনো রেলিং থেকে শিথিল হয়ে আসছে।
ঠিক এমন সময় কোথা থেকে ভেসে এলো উৎসবমুখর বাজনার ঘন আওয়াজ। দিপু সচকিত হয়ে নীচে তাকালো। ব্রীজের বরাবরএকটা মাঝারি আকারের লঞ্চ । লঞ্চের ডেকে লাল নীল সবুজ হলুদ ছোট ছোট পতাকা সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। ডেকের একদিকে যাত্রীদের কামরা ঘেঁষে ড্রাম আর ট্রাম্পেট হাতে আট দশজনের একটা ভাড়া করা ব্যান্ড পার্টি। ডেকের অন্যপাশে নানা বয়সী ছেলেমেয়ে সঙ্গীতের তালে তালে নৃত্যরত। ওদের মাথার ঠিক উপরে একটা ব্যানার বাতাসে প্রবলভাবে দুলছে। দিপু গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়লঃ বাৎসরিক বনভোজন ও আনন্দযাত্রা , লালবাগ আহসানিয়া এতিমখানা, ঢাকা-১২১১।
দিপু মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গ্যালো। এতিমখানার ছেলেদেরও এত আনন্দ? এদের তো বাব মা কেউই নেই। না কী বাবা মা নেই বলেই এরা এত সুখী? এমন আনন্দ তো ওর জীবনে কখনো আসেনি।
সেও তো এতিমখানায় থাকতে পারে। পারে না? মনের ভেতর নতুন আলো আর অন্ধকার নিয়ে দিপু ধীরে ধীরে ব্রীজ থেকে নেমে এলো।
সেই দিন সন্ধায় তুমুল হট্টগোলের ভেতর সচকিত হয়ে উঠল আজিমপুরের এলাকাবাসী। সবাই ভয়ার্ত চোখে দেখল দিপুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ার কুন্ডলীতে কালো হয়ে গেছে আজিমপুরের ঘোলাটে আকাশ।
ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি তখনো সন্ধ্যার ট্রাফিক জটলা ভেদ করে ঘটনাস্থলে আসেনি। মাগরিবের আজান শেষে ইমাম সাহেব মাইকে ঘোষণা দিচ্ছেনঃ ‘মুমিন মুসলমান ভাইবেরাদার। একটি বিশেষ ঘোষণা। আমাদের প্রিয় মুসুল্লী হামিদুর রহমান সাবের বাড়িতে বিরাট অগ্নিকান্ড ঘটিছে। আপনারা যে যার বাড়ি থিকা বালতি বালতি পানি নিয়া আগুনে নিক্ষেপ করুন। আসুন ভাইবেরাদার সবাই মিলি হামিদুর রহমান ও ওনার পরিবারকে শয়তানের আছর থিকে রক্ষা করি’।
বাড়ির পেছনের আফসানা বেগমের যত্নে গড়া আমের বাগান। সেই বাগানে একটা আমগাছের ডালের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে দিপু। বাড়ির পেছনের দেয়ালের একদম বাঁ দিকের জানালা থেকে কমলা আলো এসে পড়ছে দীপুর মুখে। ওটি দীপু আর টিপুর ঘর। সেই ভেসে আসা আলোয় দূর থেকে দেখা যাচ্ছে আবছা এক ছায়ারেখা। ছায়ারেখাটি জানালার গ্রীল ধরে ঝাঁকাচ্ছে। পেছনে আগুন আর ধোঁয়ার মাতম। কিন্তু ছায়ারেখাটি গ্রিল খুলতে পারছে না।
গ্রীলের চাবি দিপুর পকেটে।
জানালা থেকে দিপুর দূরত্ব বড়জোর পঁচিশ ফুট। দিপু চাইলেই এখনি চাবি ঘুরিয়ে গ্রিল খুলে দিতে পারে। কিন্তু দিপু যেন স্বেচ্ছায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ও নির্বিকার হয়ে দেখছে আগুনের সাথে টিপুর অসম যুদ্ধ। ধীরে ধীরে টিপুর ছায়ারেখাটি নিস্তেজ হয়ে এলিয়ে পড়ল ঘরের ভেতরে।
এরপর বিশ বছর কেটে গ্যাছে।
দিপু লালবাগ আহসানিয়া এতিমখানায় বড় হয়েছে। সময়মত লেখা পড়াও শেষ করেছে। তারপর কোন এক অজ্ঞাত কারনে অন্যসব পেশা রেখে যোগ দিয়েছে দমকল বাহিনীতে । ও এখন লালবাগ দমকল স্টেশনের ফায়ার লিডার। ঢাকার সেরা ফায়ারম্যানদের একজন। অগ্নি নির্বাপণে অসম সাহসিকতার জন্য দিপু দু দু’বার পেয়েছে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পদক ।
অথচ একদিন এক অগ্নিকান্ডের খবরে দিপুর মত অভিজ্ঞ ফায়ারম্যানের রক্তেও শীতল স্রোত বয়ে যায়। ভবনটির ঠিকানা দিপুর অতি পরিচিত। একসময় এই ঠিকানায় দিপু থাকত। তখন দিপুর বাবা ছিল, মা ছিল, ভাই ছিল।
হেমন্তের সেই ম্লান বিকেলে পি পো পি পো শব্দ করে অগ্নি নির্বাপক গাড়ি এস থামল লালবাগের সেই পুরনো ঠিকানায়। মেইন গেটের সামনেই দুটো নারকেল গাছ। দীপুর ছেলেবেলার। গাছগুলো থাকলেও বাড়িটা নেই। হামিদুর রহমান আর আফসানা বেগমের মৃত্যুর পর বাড়িটি বেশ ক’বার হাত বদল হয়েছে। পুরনো বাড়ি ভেঙ্গে এখন সেখানে আট তলা গার্মেন্টস ভবন।
আট তলা গার্মেন্টসের পাঁচ আর ছ’তলা এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে। জানালা আর ঘুলঘুলি দিয়ে ভুস ভুস করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। পোড়া পলেস্টাইরিনের উৎকট গন্ধে বাতাস পিতলের চেয়েও ভারী।
নারকেল গাছের মাথা ধোঁয়ায় ঘুটঘুটে কালো হয়ে গ্যাছে। প্রবীণ গাছ দুটো বাতাসে অস্থিরভাবে দুলছে। হঠাৎ মনে হয় দুই পরহেজগার চুল ঝাঁকিয়ে জিকির করছে। ওরা কি দিপুর উপস্থিতি টের পেয়েছে?
আজকের অ্যাসাইনমেন্টের মূল কম্যান্ডে আছেন স্টেশন অফিসার আকাশ। এককালে দর্শনের ছাত্র আকাশ সব কিছুর ভেতর এখনো দর্শন খুঁজে বেড়ান। আকাশ আজ বিশেষ চিন্তিত । পঞ্চভূতঃ ভুমি, জল, অগ্নি, বায়ু আর শূন্য সৃষ্টির আদি বস্তু। অগ্নি আর বায়ু এখন একজোট হয়ে ঘোঁট পাকিয়েছে। এভাবে বাতাস ছুটলে একটু পর শুধু জল দিয়ে আগুন নেভানো মুশকিল হয়ে পড়বে। আকাশ দূরে ফায়ার লিডার দিপুকে দেখতে পেলেন। দিপু থ মেরে নারকেল গাছ দেখছে। হাতে এ থ্রী সাইজ কাগজের রোল। এটা কী বৃক্ষমেলার সময়? আকাশ ক্ষিপ্র গতিতে দিপুর দিকে এগিয়ে গেলেন।
‘দিপু, কী করছ? ’
‘কি করব ভাবছি। বিল্ডিঙের মালিক ফ্লোর প্ল্যান রেখে গায়েব হয়ে গ্যাছে। ফায়ার স্টেয়ারের নাম নিশানা নাই’
‘ফায়ার স্টেয়ার থাকলেই বা কি, বদমায়েশরা তো তালা মেরে রাখে। ভেতরে ক’জন?’
‘রাতে তিন চারজন কর্মচারী থাকে। কোন নাইট শিফট নাই। থাকলে এতক্ষণে খবর হয়ে যেত’
‘তাড়াতাড়ি কাজে নামো। গাড়ী ভাংচুরের জন্য পাবলিক মুখিয়ে আছে। দ্যাখো দ্যাখো হারামজাদারা কিভাবে তাকাচ্ছে’
দিপু তাকিয়ে দেখল দেয়ালের ওপাশে সত্যিই অনেক লোকের ভিড়। জনগণ উত্তেজিত। কিছু একটা লণ্ডভণ্ড করার জন্য উন্মুখ। দু’একজন স্মার্ট ফোনে ছবি তুলছে। ফেইসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট করবে বোধ হয়। একজন আবার লুঙ্গির কাছা বাঁধছে। ও কি বিল্ডিং বেঁয়ে ওঠা শুরু করবে? দিপু এবার দাহ্যমান বিল্ডিঙের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘মেইন এন্ট্রিতে আগুন জ্বলছে। জানালা ভেঙ্গে ঢুকতে হবে’
‘যাই-ই করো, কুইক করো। কুইক, কুইক, কুইক।’
ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি থেকে লম্বা মই এনে চারতলার জানালার সাথে লাগানো হয়েছে। দিপু মই বেঁয়ে দ্রুত চারতলায় উঠে গেল। অ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডার দিয়ে প্রথমে লোহার গ্রিল কাটলো। জানালার কাঁচ ভেঙ্গে সতর্কভাবে ভেতরে ঢুকলো। পেছনে ফায়ারম্যান রকিব,সাথে দুজন নতুন রিক্রুট।
প্রথমেই একটা লম্বা হল ঘর। সামনে এক সারি সেলাইয়ের মেশিন। পেছনেটা ধোঁয়ায় আড়ালে ক্রমশ ঝাপসা। দূরে তীব্র আগুনের হল্কা। আগুনের পেছনে একটা কিছু কি দুলে উঠলো? দিপু মুখের অক্সিজেন মাস্কটা আরেকটু আঁটো কর বাঁধলো। তারপর দ্রুত এগোলো নড়ে ওঠার যায়গায়।
দিপু ভুল ভাবেনি। আগুনের শিখা থেকে মাত্র পাঁচ হাত দূরে একজন যুবক উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পেশী বহুল শক্তপোক্ত শরীর। নাইট গার্ড হবে কী? লোকটার বাম হাত ক্ষীণভাবে কাঁপছে। পাশেই কতগুলো তাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। সেখান থেকে সামান্য দূরে বৃদ্ধ একজন লোক। জ্ঞান হারিয়েছে অথবা বেঁচে নেই।
দিপু ওয়্যারলেসে মুখ লাগিয়ে রকিবকে আসতে বললেন। রকিব আর নতুন দুই রিক্রুট এদেরকে নীচে নামালেন। দিপু তখনো উপরে। মিনিট দশেক পর আকাশ দা’র কল এলো।
‘দিপু, ইয়াং লোকটির জ্ঞান ফিরে চ্যাচাচ্ছে। ওর ছোট ভাই এখনো ভেতরে’
‘আমি দেখছি। আপনি রকিবকে পাঠিয়ে দিন’
হল ঘরের পেছন দিকে অনেকগুলো দরোজা। প্রথম দুটো ঘরটা বাইরে থেকে তালা দেয়া। এর পাশের ঘরটাও বন্ধ কিন্তু পারটেক্সের দরজার এক পাশ পুড়ে গেছে। দিপু হাত লাগাতেই দরজাটা গাছের শুকনো বাকলের মত খসে পড়ল। এটা একটা মাঝারি মাপের রান্নাঘর। দরজার ঠিক কোনাকুনি উল্টোদিকে গ্যাসের চুলার যায়গাটা বীভৎসভাবে জ্বলছে।
রান্না ঘরের মাঝখানে একটা স্টিলের টেবিল। টেবিলের পেছন থেকে এক জোড়া পা সামান্য বের হয়ে আছে। দিপু কাছে গিয়ে দেখলো তেরো-চোদ্দ বছরের একটা ছেলে। শরীরের একদিক কাবাবের মত ঝলসানো। থার্ড ডিগ্রী বার্ন। মুখটা এ পাশ ফেরাতেই দীপুর শরীরে সহস্র ভোল্ট বিদ্যুত ঝাঁকি দিলো। টিপু না? টিপুই তো…সে রকম মুখের আদল, ঠোঁটের ভাঁজ।
ছেলেটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছে। দিপু নিজের অক্সিজেন মাস্ক খুলে ছেলেটিকে পড়িয়ে দিলো।
রকিবের আসতে দেরী হচ্ছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দীপু ছেলেটিকে হিঁচড়ে হিঁচড়ে হল ঘরে নিয়ে এলো। দিপু এখন অক্সিজেনের অভাব বোধ করছে। শরীরে তীব্র ক্লান্তি নেমে আসছে।
দূরে এখন রকিবেকে দেখা যাচ্ছে। রকিব কাছে আসতেই দিপু বললঃ
‘ওকে নিয়ে যান, আমি এখনি আসছি’
দিপুর পা চলছে না। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে কিছু শক্তি সঞ্চয় করলো। এরপর কয়েক পা এগুতেই বিকট শব্দে উপরে তাকালো। সিলিঙের একপাশ ভেঙে পড়ছে। কিছু টের পাবার আগেই দিপুর এক পা ভেঙ্গে-পড়া স্টিল বীমের নীচে আটকে গ্যালো।
দিপু নড়তে পারছে না। হাত থেকে ওয়্যারলেস ছিটকে পড়েছে চার হাত দূরে। দিপুর মাথায় অক্সিজেন সরবরাহ ক্রমশ কমে আসছে। চারদিকে টিউবলাইটের মত আলো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। দিপু কি হ্যালুসিনেশনে চলে যাচ্ছে?
দিপুর মনে হলো ও এখন সিনিয়র স্টেশন অফিসার আব্দুল জলিলের ট্রেনিং ক্লাসে। আব্দুল জলিল বলছেনঃ ‘শোনেন আগুন নিয়া এত ঘাবড়াইবার কারন নাই। আগুনে পুইড়া কেউ মইরবেন না। তার আগেই সাফোকেশন হইব। অক্সিজেন জ্বইলা শুধু কার্বন মনো অক্সাইড আর কার্বন ডাই অক্সাইড থাইকব। কার্বন মনো অক্সাইড গিলতে গিলতে হগলে পগার পার।’
দিপু এখন ওদের বাগানে দৌড়চ্ছে। পেছন থেকে ওয়াটার গান দিয়ে পানি ছেটাতে ছেটাতে টিপু ছুটে আসছে। ওর সুদর্শন চৌকশ ভাই টিপু। মা আর বাবা ঘাসের উপর নকশীকাঁথার চাদর বিছিয়ে বসেছেন। চাদরের উপর বনভোজনের খাবারের বাস্কেট। বাবা কি কথায় ভীষণ হাসছেন। মা সুখী সুখী মুখ করে বাবার কাপে কফি ঢেলে দিচ্ছে্ন।
কফির ধোঁয়ার আঁচ এখন দিপুর গায়ে এসে লাগছে।
মা হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে দীপুর চোখের দিকে তাকালেন। সুচিত্রা সেনের মত হাত নেড়ে নেড়ে গান ধরলেনঃ আগুনের পরশ মনি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য কর, এ জীবন পুণ্য কর দহন দানে।
সম্মোহনী এক শৈশব দিপুকে ক্রমশ নরম আলোর মত ঘিরে ধরছে। সেই শৈশবে পিছিয়ে যাবার ব্যাপার নেই। কারনে অকারনে মান অপমানের ভয় নেই।
সেখানে টিপু-দিপু দুজনেই মা বাবার চোখের মনি।
০১ মার্চ - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৫২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪